গুরুত্বপূর্ণ ভাব সম্প্রসারণ
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি
মূলভাব: সৌভাগ্য সকলেরই কাম্য। কিন্তু এ সৌভাগ্য অনায়াসলব্ধ নয়। একে অর্জন করতে হয় নিরলস পরিশ্রম ও একনিষ্ঠ সাধনায়। তবেই সৌভাগ্যের দ্বর্ণশিখরে আরোহণ করা যায়। সম্প্রসারিত ভাব: সংস্কৃতে একটি কথা আছে– দৈবলব্ধ অর্থের কল্পকাহিনি দুর্বল কাপুরুষের স্বপ্নবিলাস মাত্র। পৃথিবীতে সকল নির্মাণ ও সৃষ্টির পেছনে রয়েছে প্রচুর পরিশ্রম। বিশ্বসভ্যতা আপনা-আপনি গড়ে ওঠেনি। তা গড়ে উঠেছে যুগে যুগে কালে কালে বহু মানুষের অপরিসীম পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য পরিশ্রম অপরিহার্য।
শ্রমকে উন্নতির চাবিকাঠি বলা হয়। প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, সুনাম, মর্যাদা ইত্যাদি অর্জনের জন্য পরিশ্রম করা প্রয়োজন। নয়তো ব্যর্থতা এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। শ্রমবিমুখতা ও অলসতা জীবনে বয়ে আনে নিদারুণ অভিশাপ। নিরন্তর ও নিরলস শ্রম সাধনায় জীবনাকাশ থেকে দারিদ্র্যের ঘনঘটা হয় অপসারিত এবং জীবনের আঁধার গগন সফলতার নবীন সূর্যালোকে হয়ে ওঠে উদ্ভাসিত।
আধুনিক বিশ্বের প্রত্যেকটি উন্নত জাতির উন্নয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেসব জাতির প্রত্যেকেই নিরন্তর প্রচেষ্টা ও শ্রম সাধনার বিনিময়ে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে। একমাত্র শ্রমের মাধ্যমেই ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। নিরলস শ্রম সাধনায় সাফল্য অর্জনের ফলেই জীবজগতে মানুষ আজ শ্রেষ্ঠত্ব লাভে ধন্য হয়েছে। বস্তুত জগতে মানুষের প্রতিটি সাফল্যের মূলে রয়েছে মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। পরিশ্রমের সোপান বেয়েই মানুষ ওঠে সাফল্যের চূড়ায়।
মন্তব্য: পরিশ্রমই গড়ে দেয় মানুষের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ। যে জাতি পৃথিবীতে যত পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পরিশ্রম এবং সাধনাই জাতির সৌভাগ্যের নিয়ামক।
প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না
মূলভাব: প্রাণীর শুধু প্রাণ আছে বলেই তারা প্রাণী। মানুষের মন বা বিবেক আছে কিন্তু পশুদের তা নেই। কিন্তু মন এমন এক যার প্রভাবে মানুষ প্রাণী হয়েও মানুষ নামে পরিচিত। মনই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করেছে। সম্পদ সম্প্রসারিত ভাব: পৃথিবীতে যত প্রকার জীব রয়েছে তার প্রতিটিরই প্রাণ আছে। এ বিচারে মানুষও অন্য দশটা প্রাণীর মতো একটা প্রাণী।
শুধু মনই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। পৃথিবীতে নিজেকে আত্মপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য মানুষকে মহৎ গুণাবলির অধিকারী হতে হয়। মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা বিরাজমান— একটি প্রাণীসত্তা, অন্যটি মানবসত্তা। শুধু প্রাণকে ধারণ করেই মানুষ নামের যোগ্য হওয়া যায় না। জগতের অন্যান্য প্রাণীর প্রাণ আছে, অনুরূপ মানুষেরও প্রাণ আছে। কিন্তু মানুষের মাঝে এমন কতগুলো মানবীয় বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য প্রাণীর নেই। এখানেই মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য। মানুষের মন আছে বলেই মানুষ তার হৃদয়বৃত্তির বিকাশের সুযোগ পেয়েছে।
তাই অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা হয়ে দৈনন্দিন জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ- লালসা স্বার্থচিন্তা, কুমন্ত্রণা ইত্যাদির ক্লেদাক্ত স্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে। পৃথিবীতে যে প্রাণী মানবদেহের আকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেও তার হৃদয়বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে পারেনি এবং তার মনের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেনি— সে মূলত প্রাণীর সমতুল্য । যে মানুষ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করতে পারে এবং মনের মধ্যে মহৎ গুণাবলি অর্জন করে, সে যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে পারে। মনের বিকাশের মাধ্যমে মানুষ মহৎ গুণাবলি অর্জন করতে পারে এবং যথার্থ মানুষের মর্যাদা পায়। তাই শুধু প্রাণ নয়, মনই মানুষকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
মন্তব্য: মানুষ এবং পশুর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে মানুষের বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতা, মহানুভবতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি গুণ রয়েছে, কিন্তু পশুর নেই। শুধু প্রাণই নয়, মন বা বিবেকই মানুষকে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আত্মপরিচয়ের মর্যাদা দিয়েছে। ভাবসম্প্রসারণ ┃
পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে
মূলভাব: অনুসন্ধানী ও সৃষ্টিশীল মানুষ নিজের পথ নিজেই সৃষ্টি করে। পথের নিজস্ব কোনো সৃষ্টির ক্ষমতা নেই। মানুষ পথিক হয়ে নিজের প্রয়োজনে নিত্যনতুন পথের সৃষ্টি করে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন করে থাকে। সম্প্রসারিত ভাব: পথিক পৃথিবীর পথে পথে ভ্রমণকারী জীবনের রথের মতো। সে গতির প্রতীক। পথিকের পদচিহ্নে অঙ্কিত হয় পথরেখা। যে মানুষ প্রথম পথ সৃষ্টি করে মানুষকে মানুষের সাথে মিলিয়ে দেন– সেই তো যথার্থ পথিক। সে পথ বিস্তৃত হচ্ছে, আরো হবে, মানবসমাজকে আরো বৃহৎ করবে। পথ কখনো কোনো পথিকের সৃষ্টি করতে পারেনি, পারবেও না। মানুষের মুক্তির জন্য যে সব মহাপুরুষের পৃথিবীতে আগমন ঘটেছে, তাঁরাই যথার্থভাবে ‘রসতীর্থ পথের পথিক’। তাঁদের পথনির্দেশ প্রতিটি মানুষের আত্মমুক্তির ক্রমিক পরিণাম। তাঁদের প্রদর্শিত পথে চলে প্রত্যেক মানুষ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্বের নানা ধর্মের নানা সম্প্রদায়ের মহাজ্ঞানী মহাজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা যদি তাঁদের প্রদর্শিত পথে চলতে পারি তাহলে আমরাও বরণীয় ও স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারব। শুধু তা-ই নয় ভবিষ্যতে আরও অনেক যুগস্রষ্টা আসবেন যাঁরা মানবকল্যাণের প্রয়োজনে আরো নতুন নতুন পথ সৃষ্টি করবেন । উক্তিটি এ রূপক তাৎপর্যে অনুপম। মন্তব্য: মহাজ্ঞানী মহাজনেরা যে পথ সৃষ্টি করে অমর হয়ে আছেন, সে পথ মানুষের সামাজিক কল্যাণের আলোকবর্তিকা। মানুষকে নিজের প্রয়োজনে পথ সৃষ্টি করে নিতে হয়— এ সত্য মহাজ্ঞানী মহাজনরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভাবসম্প্রসারণ ┃
প্রয়োজনে যে মরিতে প্রস্তুত, বাঁচিবার অধিকার তাহারই
মূলভাব: দেশ, দেশের মানুষ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা প্রয়োজনে হাসিমুখে প্রাণ উৎসর্গ করে, অমরত্ব একমাত্র তাদেরই প্রাপ্য। সম্প্রসারিত ভাব: প্রবাদ আছে- “মৃত্যুর শীতল হস্ত, রাজার ওপরও পতিত।’ অর্থাৎ মৃত্যু অনিবার্য, এর করালগ্রাস থেকে কারো নিষ্কৃতি নেই। তবে মৃত্যুর শ্রেণিভেদ আছে। মৃত্যু কখনো কাপুরুষোচিত, কখনো স্বাভাবিক, কখনও বীরের। বীরোচিত মৃত্যুই মানুষকে অমরত্ব দান করে। মানুষমাত্রেরই অমরত্ব লাভের তীব্র ইচ্ছা। কিন্তু শতচেষ্টায়ও মানুষ মৃত্যুকে এড়াতে পারে না।
আবার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই মানুষ নতুন করে বাঁচে অনন্তকাল। যেমনিভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের বুকে আজও বেঁচে আছেন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। এ বেঁচে থাকা আর স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সাহসী সৈনিকের প্রত্যয়দীপ্ত মৃত্যু। কাপুরুষদের কাছে বেঁচে থাকা হলো প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দুয়ারে কড়া নাড়ার শামিল। অন্যদিকে, সাহসীরা মৃত্যুকে সঙ্গী করে জীবনকে উপভোগ করে বীরের মতো।
দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে গৌরবদীপ্ত অমর জীবন লাভের প্রয়োজনে মৃত্যু একান্তই তুচ্ছ। এ রকম অনন্ত বাঁচার জন্য মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে হয়। দেশের সূর্যতরুণ বীর সৈনিক এমন মৃত্যুকে মহান ও গৌরবজনক মনে করে। কারণ জীবনের জন্য অনিবার্য মৃত্যুকে বরণ করার মধ্য দিয়েই সে পৃথিবীতে অমরত্বের জয়মাল্য ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। তাই বলা হয়েছে, প্রয়োজনে যে মরতে জানে, বাঁচার অধিকার একমাত্র তারই। মন্তব্য: মহান মৃত্যুই মানুষকে অমরত্ব দান করে। কাপুরুষোচিত মৃত্যু মানুষকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে। মহান মৃত্যুকে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে আলিঙ্গন করলে গৌরব ও অমরত্ব লাভ করা যায়। ভাবসম্প্রসারণ ┃
পুষ্প আপনার জন্যে ফোটে না। পরের জন্যে তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও
মূলভাব: পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তুই নিজ ঐশ্বর্য অন্যের কল্যাণার্থে উৎসর্গ করে চলেছে। প্রকৃতির অন্যতম সৃষ্টি হলো মানুষ। সংগত কারণেই মানুষও এ নিয়মরীতির ব্যতিক্রম নয়। সম্প্রসারিত ভাব: এ সৃষ্টিজগতে প্রতিটি প্রাণী ও বস্তু একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে সৃষ্ট। সৃষ্টিতত্ত্বের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে কারও আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য জন্ম হয়নি। পরের মঙ্গল ও উপকার করার সং উদ্দেশ্যেই সকলের জন্ম। সুতরাং, পরের মঙ্গল ও উপকার করার মধ্যেই জন্মলাভের সার্থকতা নিহিত।
পুষ্প যেন আদর্শ মানবজীবনেরই প্রতিচ্ছবি। পরিস্ফুট ফুলের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য সার্থক হয়ে ওঠে তখনই যখন অন্যের তন্ময় দৃষ্টিকে তার রূপ-সুধা-রসে ভরে তোলে। ফুল তার সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও সৌরভের জন্য মানুষের কাছে পরম আকাঙ্ক্ষিত এবং আদরণীয়। প্রস্ফুটিত পুষ্প তার সৌন্দর্য ও সুরভিতে সবাইকে বিমুগ্ধ করে। পুষ্প কখনোই তার সৌন্দর্য, সুরভি ও মাধুর্যকে স্বীয় স্বার্থে ব্যয় করে না বরং অন্যের হৃদয়বৃত্তিতে আনন্দ ও ভালো লাগার প্লাবন ঘটিয়ে সে সার্থক হয়।
পৃথিবীর সাধু ও জ্ঞানী ব্যক্তিরাও অন্যের মঙ্গলার্থে নিজের জীবন অবলীলায় উৎসর্গ করতে ব্যাকুল। তাঁরা পুষ্পের মতোই নিজের সর্বস্ব মানবকল্যাণে বিলিয়ে দিয়ে তৃপ্তি লাভ করেন, পরের কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্নের জন্য মানুষের অন্তর্নিহিত মানবীয় গুণাবলিকে জাগ্রত করতে হবে। পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে জীবনের পরম সার্থকতা অর্জন করতে হবে। যে ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থ লাভের নেশায় আসক্ত, সে দেশ ও জাতির জন্য অভিশাপস্বরূপ। মন্তব্য: মানুষের জন্মলাভের মূল উদ্দেশ্য নিজেকে পুষ্পের মতো বিকশিত করা এবং নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে বিশ্বমানবের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। আর এখানেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। ভাবসম্প্রসারণ ┃
বিদ্যার সাধনা শিষ্যকে নিজে অর্জন করতে হয়।গুরু উত্তরসাধক মাত্র
মূলভাব: জ্ঞান অর্জনের দুরূহ পথে শিক্ষকরা আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা পদপ্রদর্শক। জ্ঞান অর্জন করতে হয় নিজেকেই। ব্যক্তির নিজস্ব আগ্রহ ও নিরলস পরিশ্রম দিয়েই বিদ্যা-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায়। সম্প্রসারিত ভাব: বিদ্যা সাধনা তথা শিক্ষা লাভের জন্য আমরা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে থাকি। শিক্ষার এই ধরন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় গুরু তথা শিক্ষককের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও প্রশ্নাতীত। প্রকৃত অর্থে, শিক্ষকরাই আমাদের জীবন বিনির্মাণ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন।
গুরুজন তথা শিক্ষকদের প্রদর্শিত পথেই আমরা জ্ঞানরাজ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার লাভ করি। বিদ্যার রাজ্যে আমাদের স্বচ্ছন্দ বিচরণের পেছনে শিক্ষকদের ভূমিকাই মুখ্য। বলা হয়ে থাকে মা-বাবার পরেই শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন বিনির্মাণে শিক্ষকের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। তবে বিদ্যা সাধনা বিদ্যার্থীর একান্তই নিজস্ব বিষয়। শিক্ষকদের ভূমিকার কথা স্বীকার করেও এ কথা বললে অত্যুক্তি কিংবা অতিরঞ্জন হবে না যে, নিজ চেষ্টা ও পরিশ্রম ছাড়া বিদ্যা অর্জন অসম্ভব। ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি এবং শ্রেষ্ঠ গুরুর আশীর্বাদ ধন্য হলেই বিদ্যা অর্জন কখনো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এ জন্য চাই বিদ্যার্থীর নিজস্ব একাগ্রতা ও আগ্রহ থাকা চাই।
পরিশ্রম করার মানসিকতা প্রকৃত অর্থে, নিজস্ব চেষ্টা ছাড়া কখনই বিদ্যা অর্জন করা যায় না। এমনও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েও কিংবা দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পড়েও অনেকেই বিদ্যার রাজ্যে সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। এক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীর বিদ্যা অর্জনে অনীহা ও ঔদাসীন্যই দায়ী থাকে। আমরা যদি পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী ও মহাজনদের জীবন ইতিহাসের দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাবো, তারা নিজস্ব চেষ্টা ও সাধনার মধ্য দিয়েই বিদ্যা অর্জন করেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে মহামানব হিসেবে তারা নিজের স্থান পাকা করে নিয়েছেন। আলবার্ট আইনস্টাইন কখনোই নিজেকে ভালো ছাত্র হিসেবে তুলে ধরতে পারেননি। নিজ সাধনা ও ঐকান্তিক চেষ্টার বলে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল— এই গ্রিক দার্শনিকত্রয়ের জীবনের দিকে তাকালেও এই সত্য উন্মোচিত হয়। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় প্লেটো যেমন সক্রেটিসকে অত্রিম করে। গেছেন, তেমনি আরিস্টটলও প্লেটোকে অতিক্রম করে গেছেন।
সক্রেটিস তো তাঁর শিষ্য প্লেটোর লেখনীর মধ্য দিয়ে আমাদের স্মৃতিতে অমর হয়ে আছেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে এ রকম ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যাবে। নিজস্ব সাধনা ও প্রচেষ্টা না থাকলে শ্রেষ্ঠ গুরুর সান্নিধ্যও কোনো কাজে আসে না। প্রকৃত বিদ্যা অর্জন অধরাই থেকে যায়। মন্তব্য: গুরুজন তথা শিক্ষক আমাদের জীবনে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষকদের এই ঋণ স্বীকার করেই আমরা বিদ্যা অর্জনের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য নিজস্ব মেধাকে কাজে লাগানো ও পরিশ্রম করা নিজস্ব মেধা ও মননের চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃত বিদ্যা অর্জন করতে পারব। নচেৎ শ্রেষ্ঠ গুরুর সান্নিধ্য অসার ও নিষ্ফল থেকে যাবে। ভাবসম্প্রসারণ ┃
ভোগে সুখ নাই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ
মূলভাব: দেশ ও মানবকল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে ত্যাগের অনন্ত মহিমা। আর এ ত্যাগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত সুখ। ভোগলিপ্সা মানুষকে শুধু লোভী করে তোলে, সুখী করতে পারে না। সম্প্রসারিত ভাব: মানুষ স্বভাবতই প্রবৃত্তির দাস। প্রবৃত্তির শৃঙ্খল মোচনের মাধ্যমেই মানুষের মুক্তি ঘটে। আর এ মুক্তির মাধ্যমেই পাওয়া যায় জীবনের আস্বাদ। ভোগে আসক্তি জন্ম নেয়, আসক্তির দ্বারা ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়ে।
মানুষ তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হয়ে সে যন্ত্রণাময় জীবনযাপন করে। প্রচুর ধনসম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও মনের দিক দিয়ে সে হয় দরিদ্রের চেয়েও দরিদ্র। ভোগের বশবর্তী লোক নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থেই মশগুল থাকে। তার দ্বারা পৃথিবীর মানুষের জন্য কোনো মহৎ কাজ করা সম্ভব হয় না। মৃত্যুর সাথে সাথে তার স্মৃতি মানুষের কাছে ম্লান হয়ে যায়। অপর পক্ষে, ত্যাগের মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই স্বীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল হতে পারে। ত্যাগের মাধ্যমেই মানুষ পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করে, পৃথিবীর মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পায়।
ত্যাগেই মানবজীবনের সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়, মানুষ প্রকৃত সুখ লাভে সক্ষম হয়। তাই ত্যাগই আমাদের চরিত্রের সর্বোচ্চ আদর্শ হওয়া উচিত। ত্যাগই মহাশক্তি। কেবল ত্যাগের দ্বারাই মানবজীবন সার্থক করা সম্ভব। মানুষ যদি অপরের কল্যাণে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করে তাতে তার চরিত্রে মহত্ত্বেরই প্রকাশ ঘটে। এখানেই জীবনের যথার্থ গৌরব, প্রকৃত সুখ। মন্তব্য: জীবনের সুন্দর বিকাশের জন্যে স্বার্থত্যাগ বাঞ্ছনীয়। ভোগে জীবনের কোনো সার্থকতা নেই, নেই ন্যূনতম সুখ পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাঝেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। ভাবসম্প্রসারণ ┃
মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে
মূলভাব: মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন কর্ম-ঐশ্বর্য দ্বারা সম্ভব। যে ঐশ্বর্য মানুষের মঙ্গল সাধনে সমর্থ তা-ই প্রকৃতপক্ষে ধন, বিলাসিতায় ব্যয়িত অর্থ প্রকৃত ধন নয়। বরং পরোপকারে নিয়োজিত করলে তার অর্জন ও ব্যয়ের সার্থকতা প্রমাণিত হয়। সম্প্রসারিত ভাব: জগতের যাবতীয় মঙ্গল কাজের নেপথ্যে রয়েছে অর্থ। অর্থ ছাড়া কোনো কাজই সম্পন্ন করা যায় না। আবার উপার্জিত অর্থ বিলাসের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে সমাজ বা জগতের যেমন কোনো কল্যাণ সাধিত হয় না, ঠিক তেমনই বিপুল অর্থের পাহাড় শুধু ধনভাণ্ডারে জমা রাখলেও সে অর্থ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। কাজেই বিবেচনা করে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করা উচিত।
সঞ্চয় বা কৃপণতা কোনোটার মাঝেই অর্থ বা ধনসম্পদের সার্থকতা নেই। সদ্ব্যবহারের মাঝেই রয়েছে এর পূর্ণ সার্থকতা। কৃপণতা বা বিলাসিতা দিয়ে অর্থের সদ্ব্যবহার হয় না। যে ধনসম্পদ দিয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয় না, কিংবা যে ধন-সম্পদ দিয়ে বিলাসের বন্যায় গা ভাসিয়ে শুধু খেয়াল চরিতার্থ করা হয়, সে ধনসম্পদ নিতান্তই মূল্যহীন। মানবকল্যাণ ও সামাজিক মঙ্গল সাধনের উদ্দেশ্যেই ধনসম্পদ বা অর্থের জন্ম।
কাজেই মানুষ ও সমাজের কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে অর্জিত অর্থই সম্পদ। বিলাসিতা বা অপব্যয়ের উদ্দেশ্যে সঞ্চিত অর্থ প্রকৃতপক্ষে ধন হিসেবে বিবেচ্য নয়। সমাজের চারদিকে যত দরিদ্র অসহায় মানুষ আছে তাদের মঙ্গলার্থে অর্থ ব্যয় করা উচিত। নিজের বিলাসিতায় সকল অর্থ ব্যয় করে দরিদ্র মানুষকে বঞ্চিত করার মাঝে কোন সার্থকতা নেই। মন্তব্য: যে অর্থ মানুষের কল্যাণকর্মে ব্যয় হয় না, সেই অর্থের কোনো সার্থকতা নেই। মানবকল্যাণে ব্যয় করা সম্পদই ধন। তাই অর্জিত অর্থকে মানবকল্যাণে ব্যয় করা উচিত। ভাবসম্প্রসারণ ┃
যে সহে, সে রহে
মূলভাব: জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সহনশীলতার কোনো বিকল্প নেই। প্রত্যেক মানুষের জীবনে জয়-পরাজয় আছে। যে মানুষ পরাজয়কে স্বীকার করে নিয়ে পরবর্তী বিজয়ের জন্যে ব্রতী হয়, সে-ই যথার্থ বিজয় অর্জন করতে পারে · সম্প্রসারিত ভাব: জীবন পুষ্প শয্যা নয়। পৃথিবীতে জীবনের চলার পথ কণ্টকাকীর্ণ। এখানে প্রতি পদেই রয়েছে বাধা-বিপত্তি ও সংঘাত। ধৈর্য ও সহনশীলতা মানবজীবনের বৈশিষ্ট্য। ধৈর্যশীল হতে পারলেই এ সংঘাতময় পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করা সম্ভব, নতুবা পতন অনিবার্য। সোনা পুড়ে যেমন খাঁটি হয়— দুঃখ, দুর্দশার আঘাতে আমাদের মনও স্বচ্ছ এবং দৃঢ় হয়। পৃথিবীতে যারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তার মূলে ছিল ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু তিনি ধৈর্য হারাননি এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। কাজী নজরুল ইসলামের সহনশীলতার বহু উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। এ কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র পেয়েছেন বিদ্যাসাগর অভিধা এবং কাজী নজরুল ইসলাম পেয়েছেন বিদ্রোহী কবির অভিধা। সহনশীলতার ঐশ্বর্যমণ্ডিত গুণেই পৃথিবীতে বিখ্যাত মনীষীগণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। “বিশ্বনন্দিত বৈজ্ঞানিক ডারউইন প্রাণিজগতের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেন যে, এই সংগ্রাময় পৃথিবীতে যোগ্যতম জীবেরাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। মানুষের জীবনযাত্রা এক নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস। এ পার্থিব জীবন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। যারা ধৈর্যশীল তারাই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী এবং জীবন পথের অগ্রসেনা।
জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য তারা সব প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে অপেক্ষায় থাকে বিজয়ের। অবশেষে বিজয়ের মালা সে-ই অর্জন করে। অপরদিকে, যে ব্যক্তি এসব প্রতিকূলতাকে রা সহ্য করতে পারে না তাদের পক্ষে বিজয় অর্জনও সম্ভব হয় না। এ মন্তব্য: জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের পূর্বশর্ত ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতাই ম মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণচূড়ায় পৌছে দেয়। সহিষ্ণুতা ছাড়া জীবনের সোনালি রোদ্দুর কল্পনাতীত ।
যে একা সেই সামান্য, যার ঐ নাই সে তুচ্ছ
মূলভাব: পৃথিবীতে যে ব্যক্তি একা সে নিঃসন্দেহে অসহায়। ঐক্যবদ্ধ জীবনপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে সে শক্তিতে সামান্য এবং সামাজিকভাবে তুচ্ছ। সম্প্রসারিত ভাব: পৃথিবীর আদি পূর্বে মানুষ ছিল ভীষণ অসহায়। কারণ তখন সে ছিল একা, ঐক্যবদ্ধহীন। সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ উপলব্ধি করল, ঐক্যবদ্ধ জীবন ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূলতার কাছে সে তুচ্ছ।
তাই মানুষ স্বীয় প্রয়োজনে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গড়ে তোলে সমাজবদ্ধ জীবন, হয়ে ওঠে সামাজিক বলে বলীয়ান। আজকের সমাজবদ্ধ মানুষের পৃথিবীতে যে একা, সেই অসহায়। আর যে অসহায় তার সামর্থ্য নেই বললেই চলে। শক্তি বা সামর্থ্যের ক্ষুদ্রতার কারণে একক মানুষ সকলের নিকট উপেক্ষিত ও অবাঞ্ছিত। যারা ঐক্যবদ্ধ তাদের শক্তি অসীম। ঐক্যই প্রকৃত শক্তি। বিন্দু বিন্দু জলের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় বিশাল জলধি, আর বিন্দু বিন্দু শক্তির সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় অসীম শক্তি ।
ঠিক এমনইভাবে অনেক ব্যক্তিসত্তা যখন একতাবদ্ধ হয়ে সমষ্টির সৃষ্টি করে তখন তাদের সমবেত শক্তি জাতীয় জীবনে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম। একতার শক্তি অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করে। আমাদের জাতীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে একতার প্রয়োজন সর্বাধিক। মন্তব্য: প্রবাদ আছে- ‘একতাই বল।’ মানুষ এককভাবে সামান্য আর তুচ্ছ বলেই সভ্যতার উন্নতির বিকাশে চাই মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। যে জাতি দ্বিধাবিভক্ত সে জাতি দুর্বল ও নিরাপত্তাহীন। তাই ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উন্নয়নের জন্যে একতাবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। ভাবসম্প্রসারণ ┃
মূলভাব: সুখ ও দুঃখ মানবজীবনে পালা করে আসে। রাতের গভীরতা যেমন প্রভাতের বার্তাবাহী তেমনই গভীর ও দীর্ঘ দুঃখও ভবিষ্যৎ সুখের বার্তা নিয়ে আসে মানুষের জীবনে। সম্প্রসারিত ভাব: মানুষকে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয় জীবনে। অস্তিত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েই তাকে এ সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। জীবন চলার পথে মানুষের জীবনে আসে পদে পদে বাধা। এ বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করে মানুষকে পথ চলতে হয়। দুঃখ মানবজীবনের এক অনিবার্য নিয়তি। দুঃখকে জয় করেই মানবজীবনের অভিযাত্রা। একই ধারায় জীবন প্রবাহিত হবে এমনটি প্রত্যাশা করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
জীবনপথের সকল কাঁটা নিজ হাতে উপড়ে ফেলে সাফল্যের দিকে, অগ্রগতির দিকে মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়। তবে একথাও সত্য যে, রাতের পর যেমন আসে উজ্জ্বল সোনালি প্রভাত তেমনই দুঃখের পরও আসে সুখ। কারো জীবনই শুধু দুঃখ দিয়ে গড়া নয়। আবার কারো জীবনেই নিরন্তর সুখ থাকে না। সুখ ও দুঃখের পালাবদল ঘটে। প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যার নেই, জীবনযুদ্ধে সে পরাজিত হয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যোগ্যতা, সহিঞ্চুতা, ধৈর্য ও মনোবল দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করাই শ্রেয়। কোনোভাবেই হতোদ্যম হলে চলবে না। জীবনের জন্য চাই বলিষ্ঠ উদ্যম। উজ্জীবিত মানুষই জীবনে সফল হতে পারে।
রাত ‘যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে – সত্যটি মনে রেখে মানুষকে প্রয়োজনে দুঃখের নদীতে ঝাঁপ দিতে হয়। দুঃখকে জয় করেই সুখকে লাভ করতে হয়। বিপদে দিশেহারা হলে চলে না। ঠাণ্ডা মাথায় বিপদকে মোকাবিলা করে নিজের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হয়। বিশ্বাস রাখতে হয় যে, দুঃখের তিমির রাত্রি পেরিয়ে সুখ ও আনন্দময় উজ্জ্বল দিন একদিন আসবেই। মন্তব্য: সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন। দুঃখকে জয় করেই সুখ লাভ সম্ভব হয়। তাই জীবনে দুঃখ-কষ্ট নেমে আসলে হতাশ না হয়ে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং সুখের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। বা শিক্ষাই জাতির উন্নতির পূর্বশর্ত
মূলভাব: জাতীয় জীবনে অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে না। শিক্ষার প্রভাবেই মানুষ কুসংস্কার, জড়তা ও হীনতা থেকে মুক্ত হয়ে জাতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পারে। সম্প্রসারিত ভাব: মেরুদণ্ডহীন মানুষ জড় পদার্থের মতো স্থবির, অচল জীবনূতের মতো সে এ সংসারে জীবনযাপন করে থাকে। তার দ্বারা সমাজ তথা দেশের কোনো মঙ্গল আশা করা অসম্ভব ব্যাপার জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয়ে সে বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হয়।
তাই মানুষকে সচল ও দণ্ডায়মান রাখতে যেমন মেরুদণ্ড প্রয়োজন, তেমনই কোনো জাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে মেরুদণ্ডসম শিক্ষার গুরুত্বও অপরিসীম। সাম্প্রতিক বিশ্বে যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি পৃথিবীকে করেছে তত প্রভাবিত। শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনা ছাড়া কোনো জাতি বড় হতে পারে না। শিক্ষা-দীক্ষাহীন জাতি পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের ন্যায় অচল। তাই শিক্ষাকে মেরুদণ্ডের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন জগৎ-সংসারে অথর্ব, মূল্যহীন তেমনই শিক্ষাহীন জাতি অচল, অসার। প্রায় এক যুগ আগে ফিলিপাইনের মিন্দানাও দ্বীপে প্রাগৈতিহাসিক একটি জনগোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গেছে।
তাদের শিক্ষা বা সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। ফলে তারা প্রকৃতির খেয়ালের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় প্রায় বিলুপ্ত হতে যাচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে তারা শিক্ষিত মানবসমাজের সংস্পর্শ পেয়ে অনিবার্য ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষা করার সুযোগ লাভ করেছে। শিক্ষার প্রভাবেই মানুষ নানা কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে জাতিকে নিয়ে যেতে পারে উন্নতির চরম শিখরে। তাই শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ডরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মন্তব্য: শিক্ষাই জাতির আত্মপরিচয়ের বাহন। জাতিকে বিশ্বদরবারে উন্নত মর্যাদাশীল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন
মূলভাব: পরাধীন জাতির পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন অত্যন্ত কঠিন কাজ। স্বাধীনতা অর্জিত হলেই তা চিরস্থায়ী হয় না। অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করা আরো কঠিন কাজ। তাই স্বাধীনতা রক্ষায় জাতিকে থাকতে হবে সদাজাগ্রত। সম্প্রসারিত ভাব: স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। আর মানুষ মাত্রই স্বাধীনতাপ্রিয়। তার জীবনের প্রধান আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতা। স্বাধীনতা কথাটি যতই মধুর হোক না কেন এটা অর্জন করা বড়ই কঠিন। এটাকে পাওয়ার জন্যেই মানুষ যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে আসছে। নিপীড়িত, অত্যাচারিত জাতি স্বীয় মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তিলাভ করে থাকে। কিন্তু এ মুক্তি অর্জনই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়।
একে সমুন্নত রাখাই মুখ্য উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের পুনর্গঠন, উন্নয়ন ও বহিঃশত্রুর হাত থেকে একে রক্ষা করার জন্যে সদাপ্রস্তুত থাকা একান্ত প্রয়োজন। স্বাধীনতা লাভের পর পরাধীনের মতো জীবনযাপন না করে বলিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে স্বাধীনতাকে অম্লান রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব। অপরপক্ষে, স্বাধীনতা লাভ করেই কোনো জাতি যদি আত্মতুষ্টি অনুভব করতে শুরু করে, জাতি গঠনে সর্বস্ব নিয়োগ না করে স্বার্থপরতায় মগ্ন থাকে, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন না থাকে তবে অর্জিত ঈপ্সিত স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়বে। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপের মূল | দে ব উদ্দেশ্য হওয়া উচিত স্বাধীনতাপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল জীবনের বিকাশ, অর্জিত স্বাধীনতা সুরক্ষা করেই তা করতে হবে।
সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত
মূলভাব: শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শিক্ষার দিকনির্দেশনা দেন। সেই দিকনির্দেশনা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীর সফল হয়ে ওঠাই হলো সুশিক্ষিত হয়ে ওঠার নামান্তর। তবে প্রতিটি সুশিক্ষিত মানুষই স্বশিক্ষিত। সম্প্রসারিত ভাব: জন্মের পর থেকেই মানুষ তার পরিবার, পরিবেশ, আত্মীয়-পরিজন থেকে শিক্ষাগ্রহণ শুরু করে এবং একটা পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করে সনদপত্র লাভ করে। কিন্তু এ স্বীকৃতি কিংবা পরীক্ষায় পাস করাই প্রকৃত শিক্ষা নয়। প্রকৃত শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না।
উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া কিংবা ভালো ফলাফল করলেই প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায় না। এসব অনেক সময় শিক্ষার্থীর প্রকৃত শিক্ষার, সীমাবদ্ধতাকে আড়াল করে শিক্ষার্থীর কৃতিত্ব প্রদর্শন সম্ভব করে তুললেও এটাকে সুশিক্ষা বলা যায় না। স্ব-অর্জিত শিক্ষাই মানুষকে সুশিক্ষিত করে তোলে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জ্ঞানচর্চা এবং জ্ঞান আহরণের পথকে অনেক সময় সুগম করে তুললেও জ্ঞানের পূর্ণতা আসে না। নিজ চেষ্টায় যে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিচালিত করে অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যায়, তার মধ্যে মৌলিকতার উন্মেষ ঘটে। এজন্যে দরকার একাগ্রতা ও প্রচুর পরিশ্রম। এর ফলেই জ্ঞানের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করা সম্ভব। স্বীয় চেষ্টা দ্বারাই মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিচালিত করে, স্বকীয়তা ও মৌলিকতার উন্মেষ ঘটিয়ে শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে সে বিচরণ করতে পারে।
এভাবে মানুষ হয়ে ওঠে সুশিক্ষিত। যোগ্যতার দ্বারাই সে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে। তাই দেখা যায়, প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা মুখ্য নয়। কেননা পৃথিবীতে অনেক সুশিক্ষিত ব্যক্তি আছেন যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গণ্ডি অতিক্রম করেননি। শিক্ষার মাধ্যমে আত্মার বিকাশ ঘটে। আর এ শিক্ষা অর্জনের জন্যে চাই সাধনা । মন্তব্য: সুশিক্ষিত ব্যক্তি তিনিই যাঁর মন কুসংস্কারমুক্ত ও মুক্তবুদ্ধির আলোকে উদ্ভাসিত। যিনি পরিশীলিত রুচিবোধে নম্র ও উদার তাঁকেই সুশিক্ষিত বলা চলে। এ সুশিক্ষা তাঁর স্বীয় সাধনা দ্বারা অর্জিত। এ শ্রেণির মানুষই আলোকিত মানুষ।
স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো
মূলভাব: স্পষ্টভাষী শত্রু প্রতিপক্ষের দোষত্রুটি উন্মোচন করে প্রতিপক্ষকে শোধরানোর সুযোগ করে দেয়। অন্যদিকে, নির্বাক মিত্র বন্ধুর ভুল না ধরিয়ে দিয়ে তার জীবনের পতনকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। নির্বাক মিত্র সুবিধাভোগী চরিত্রের হয় বলে বন্ধুর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। অন্যদিকে, স্পষ্টভাষী শত্রুর দ্বারা প্রতিপক্ষ উপকৃত হয় চূড়ান্ত বিচারে।
সম্প্রসারিত ভাব: মানুষের জীবন চলার পথে নির্ভরযোগ্য বন্ধুর প্রয়োজন । জীবনে চলার পথে না চাইলেও মানুষের শত্রু সৃষ্টি হয়। বন্ধু এবং শত্রুর বৃত্তের ভেতরেই মানুষকে তার জীবন পরিচালিত করতে হয়। তবে কে যে আসল বন্ধু, কে যে শত্রু সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ করে মানুষকে পথ চলতে হয়। শত্রু-মিত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন যদি সঠিক না হয় তাহলে মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সাধারণ বিচারে মানুষের কাছে শত্রু কাম্য নয় বরং বন্ধু পরম আকাঙ্ক্ষার ধন। কিন্তু শত্রু যদি স্পষ্টভাষী হয় তাহলে দেখা যায়, সে শত্রু নির্বাক বন্ধুর চেয়ে ভালো।
কেননা নির্বাক বন্ধু মানুষের দোষত্রুটি সম্পর্কে মন্তব্য না করে, বন্ধুর হ্যাঁতে হ্যাঁ মিলিয়ে সে মূলত সুবিধাভোগী চরিত্রের ভূমিকা পালন করে প্রকৃতপক্ষে মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যেই রাখে । অন্যদিকে, স্পষ্টভাষী শত্রু মানুষের দোষত্রুটিগুলো তুলে ধরে প্রকৃতপক্ষে তাঁর উপকার করে। স্পষ্টভাষী শত্রুর এ ধরনের ভূমিকার কারণে মানুষ নিজেকে শুধরিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করতে পারে। মন্তব্য: জীবনের প্রয়োজনে উপকারে না এলে কোনো সম্পর্কেরই যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। স্পষ্টভাষী শত্রুর দ্বারা মানুষের উপকার হয় বলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো। ভাবসম্প্রসারণ ┃
সাহিত্য জাতির দর্পণস্বরূপ
মূলভাব: সাহিত্যের মাধ্যমে একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় বিধৃত হয়। তাই কোনো জাতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে হলে, সে জাতির সাহিত্য পাঠ অত্যাবশ্যক। সম্প্রসারিত ভাব: একটি জাতির চিন্তাচেতনা-ধ্যানধারণা সাহিত্যের মধ্যে বিধৃত হয়। কবি, সাহিত্যিকরা প্রতিনিধি হিসেবে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ করে থাকেন।
তাঁরা চারপাশের জীবনাচরণকে তাঁদের লেখার প্রধান উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করায় সাহিত্য আয়নার কাজ করে। আর তাতে জাতির সঠিক প্রতিবিম্ব দেখা যায়। সাহিত্যের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ ও গণমানুষের উন্নতি সাধন করা। জাতীয় ঐতিহ্য সাহিত্যের প্রধান উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতির সমৃদ্ধির মূল্যায়ন সাহিত্যের সমৃদ্ধির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কেননা প্রত্যেক জাতির সাহিত্য পাঠ করে সে জাতির রীতি-নীতি আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানা যায়। সাহিত্য কেবলই কোনো জাতির পরিচায়ক নয় বরং এর মাধ্যমে মানুষের মন কুসংস্কারমুক্ত হয়ে সৌন্দর্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
জাতীয় জীবনে এত বেশি অবদানের জন্যই সাহিত্যকে আয়নার সাথে তুলনা করা হয়েছে। কালের গর্ভে কোনো জাতি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, তার চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার সাহিত্য থাকে চির অম্লান। কালের ধুলোয় সাহিত্য মলিন হয়ে যায় না বরং জাতির কার্যমহিমা ও ইতিহাস যুগে যুগে আমাদের সামনে মূর্ত করে তোলে। মন্তব্য: সাহিত্যে জাতীয় চিন্তাধারা ও বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। মানুষের ভেতরের সৌন্দর্যকে প্রকাশ ও সুস্থ চিন্তার উন্মেষ ঘটানোই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। তাই সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে যত্নশীল হওয়া আবশ্যক। এ কারণেই সাহিত্য হচ্ছে জাতির মননের আয়না।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস
মূলভাব: মানুষের নিরন্তর পরিশ্রম করার মানসিকতা ও জানার আগ্রহ মানুষকে সভ্যতার অগ্রযাত্রায় এগিয়ে দিয়েছে। সে এখন আর অদৃষ্টের হাতে সমর্পিত নয়। মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা। সম্প্রসারিত ভাব: একটা সময় ছিল মানুষ অদৃষ্টের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করত। সে বিশ্বাস করত পূর্বজন্মের কর্মফলই এ জন্মের কর্মের নিয়ন্ত্রক ও নিয়ামক।
কিন্তু এ বিশ্বাস এখন নেই। মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টায় বিজ্ঞান খুলে দিয়েছে অতীতের অনেক অজানা রহস্যের দ্বার। মানুষ চাঁদে গেছে, আবিষ্কার করেছে গ্রহ, তারা, নক্ষত্রপুঞ্জ। জেনে গেছে এঁদের প্রকৃত রহস্য। আয়ত্ত করেছে অজানা শক্তিকে। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেকে। একথা সত্য, যে বিষয়গুলোর রহস্য আবিষ্কার সম্ভব হয়নি সেগুলোর ক্ষেত্রে অদৃষ্ট কথাটি থেকে যাচ্ছে। তবে হাজার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমায় সময় ও সভ্যতার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আজকের দিনে মানুষ আর ভাগ্যের লিখন বা কপালের দোহাই দিয়ে বসে থাকতে রাজি নয়।
জানার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা আর নিরন্তর প্রচেষ্টা অনেক অজানা রহস্যকে মানুষের দৃষ্টিসীমার আয়ত্তে এনে দিচ্ছে। নিয়তি নির্ভরতা মানুষকে অকর্মণ্য ও অলস করে তোলে। অসম্ভব কাজকে নিয়তির খেলা আখ্যা দিয়ে বর্জনের কোনো সুযোগ নেই। বরং আপন অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে, কর্ম দ্বারা সকল অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তার অসাধ্য কিছুই নেই। অদৃষ্টকে অলীক প্রমাণিত করে কর্মের মন্ত্র দিয়েই সে জগৎ জয় করেছে। এতে সে হয়েছে ব্যর্থ কিংবা সফল। কিন্তু ব্যর্থতার গ্লানিও তাকে থামিয়ে দেয়নি বরং তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে হয়ে উঠেছে আরো বেশি অধ্যবসায়ী । মন্তব্য: আত্মবিশ্বাসী মানুষ অদৃষ্টের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে না বরং জানার নিরন্তর প্রচেষ্টায় অদৃষ্টকে পরিহাস করে সংগ্রামী হয়ে ওঠে। অদৃষ্টের প্রতি আস্থাশীলতা মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে।
জ্ঞানশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য
সম্প্রসারিত ভাব: জ্ঞানশক্তি অর্জনই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ জ্ঞানশক্তি একজন মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে, তাকে বাঁচার মতো বাঁচতে শেখায়। এ শক্তি অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ তার নিজের, পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের উন্নতি করতে পারে। জ্ঞানশক্তি অর্জনের মাধ্যমে মানুষের জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে।
মানব ও মানবজীবন সম্পর্কিত যাবতীয় কর্মকাণ্ডে মহৎ গুণাবলি, শক্তি সঞ্চারিত হয়। জ্ঞান ছাড়া জীবনে চলার পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। জ্ঞানই জীবনে আলো ছড়ায়। আমরা যদি আলোকিত জীবনের সন্ধান পেতে চাই তাহলে আমাদের জ্ঞানের কাছে বারবার ফিরে আসতে হবে। তা না হলে জীবনে দুর্ভাগ্য এবং দুর্ভোগ নেমে আসতে বাধ্য। জ্ঞানই হচ্ছে মানুষের জীবনের পরশপাথর। পরশপাথরের মতো স্পর্শ দিয়ে জীবনকে ফুলে-ফলে বিকশিত করে তোলে জ্ঞানশক্তি। জ্ঞান তার সমস্ত শক্তি দিয়ে জীবনের প্রতিকূলতাকে জয় করতে এবং আত্মাকে বিনির্মাণ করতে সহায়তা করে।
জ্ঞানই আত্মিক, জাগতিক সকল কিছুর সফল বিকাশ ঘটায়। এ জ্ঞানশক্তিই মানুষকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সফল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের জানা, বোঝা, শেখার কৌশলের সাথে সমন্বয় সাধন করে। আমাদের জীবনকে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে উল্লসিত করার ক্ষেত্রে জ্ঞানশক্তির কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞানী ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সুস্থ, সুন্দর ও সফল খাতে প্রবাহিত করে। এজন্যই ‘শিখা’ পত্রিকার আদর্শবাণী ছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। জ্ঞানের নিরলস সাধনা জীবনকে উন্নত করে, শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে। মন্তব্য: শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো জ্ঞানশক্তি অর্জন। শিক্ষা ছাড়া জ্ঞানের কথা ভাবাই যায় না। জীবনের বহুমাত্রিক প্রায়োগিক উপযোগিতা শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই জ্ঞানের মাধ্যমে বিকশিত হয়।